ব্যাকরণে সমাস কথাটির অর্থ হল সংক্ষিপ্ত বা সংক্ষেপ । ব্যুৎপত্তিগত অর্থ অর্থাৎ সম্ —√অস্ + ঘঞ্ = সমাস হয় যার অর্থ হল সংক্ষেপ । মনের ভাবকে যথাযথভাবে সহজ সরল ও সংক্ষেপে প্রকাশ করার জন্য সমাস পড়া বা জানার প্রয়োজন । তাই সমাস বলতে আমরা বুঝি বাক্যের দুই বা তার বেশি পদকে এক পদে পরিণত করে সংক্ষেপ করার রীতিকে বলা হয় সমাস । সমাসের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দিক হল—
(১) সমস্যমান পদ
(২) ব্যাসবাক্য
(৩) সমস্তপদ /সমাসবদ্ধ পদ ।
(১) সমস্যমান পদ — যে সকল পদের যোগে সমাস তৈরি হয় তাদের সমস্যমান পদ বলে । যেমন— পথের রাজা = রাজপথ, বিলেত থেকে ফেরত = বিলেত ফেরত । এখানে 'পথের', 'বিলেত' হল পূর্বপদ । রাজা, ফেরত হল পরপদ বা উত্তরপদ ।
(২) ব্যাসবাক্য/ বিগ্রহ বাক্য — সমস্যমান পদগুলি দিয়ে যে বাক্য বা বাক্যাংশ তৈরি হয় তাকে ব্যাসবাক্য বলে । যেমন— বিলেত থেকে ফেরত, পথে রাজা ।
(৩) সমস্তপদ বা সমাসবদ্ধ পদ — পূর্বপদ ও পরপদ বা উত্তরপদের মিলনে যে নতুন পদ সৃষ্টি হয় তাকে বলে সমস্তপদ ।
রাজার পুত্র = রাজপুত্র —এই সমাসটিতে 'রাজার পুত্র' —হল ব্যাস বাক্য, 'রাজপুত্র' —হল সমস্তপদ, 'রাজার' এবং 'পুত্র' —হল সমস্যমান পদ ।
♦ সন্ধি ও সমাসের পার্থক্য :-
(ক) সন্ধি হল বর্ণের সঙ্গে বর্ণের মিলন আর পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত দুই বা তার বেশি পদের একপদে পরিণত হওয়াই হল সমাস । যেমন দেব + আলয় = দেবালয় → সন্ধি, দেবের আলয় = দেবালয় → সমাস ।
(খ) সন্ধিতে উভয় পদের অর্থ বজায় থাকে কিন্তু সমাসের ক্ষেত্রে দ্বন্দ্ব সমাস ছাড়া অন্য সমাসে সমানভাবে গুরুত্ব নাও পেতে পারে । নব + অন্ন = নবান্ন → সন্ধি । দশ আনন যার = দশানন → সমাস ।
(গ) সন্ধিতে বিভক্তি লোপ পায় না কিন্তু সমাসে বিভক্তি লোপ পায় । সিংহ + আসন = সিংহাসন → সন্ধি । সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন → সমাস ।
♦ সমাসের শ্রেণীবিভাগ :- বাংলা ভাষায় সমাস মূলত ছয় প্রকার— (১) তৎপুরুষ, (২) কর্মধারয়, (৩) দ্বন্দ্ব, (৪) দ্বিগু, (৫) বহুব্রীহি, (৬) অব্যয়ীভাব । এছাড়াও (৭) নিত্য সমাস, (৮) বাক্যাশ্রয়ী সমাস ও (৯) অলোপ সমাস আছে ।
(১) তৎপুরুষ সমাস:- যে সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি বা অনুসর্গ লোপ পায় এবং পরপদ বা উত্তরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে তৎপুরুষ সমাস বলে । যেমন— গোলায় ভরা = গোলাভরা । বধুকে দেখা = বধু দেখা । জল থেকে আতঙ্ক = জলাতঙ্ক । এখানে 'য়' 'কে' হল দুটি বিভক্তি এবং 'থেকে' হল অনুসর্গ ।
তৎপুরুষ সমাসের শ্রেণীবিভাগ— কারক ও অকারকের বিভক্তি অনুযায়ী তৎপুরুষ সমাসকে ছটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে ।
(ক) কর্ম তৎপুরুষ সমাস :- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের কর্ম বিভক্তি লোপ পায় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে কর্ম তৎপুরুষ বলে । যেমন— মাছকে ধরা = মাছ ধরা । ধানকে কাটা = ধানকাটা । গাড়িকে চালানো = গাড়িচালানো । ফুলকে তোলা = ফুলতোলা ।
(খ) করণ তৎপুরুষ সমাস:- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের তৃতীয় বা করণের বিভক্তি/অনুসর্গ লোপ পায় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে করণ তৎপুরুষ সমাস বলে । যেমন— ঢেঁকি দ্বারা ছাঁটা = ঢেঁকিছাঁটা । মায়া দ্বারা কান্না = মায়াকান্না । শ্রী দ্বারা হীন = শ্রীহীন । সীমা দ্বারা বদ্ধ = সীমাবদ্ধ ।
(গ) নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাস:- যে তৎপুরুষ সমাসে নিমিত্ত কারকের বিভক্তি বা অনুসর্গ লোপ পায় তাকে নিমিত্ত তৎপুরুষ বলে । যেমন— লোকের নিমিত্ত হিত = লোকহিত । বিদ্যার নিমিত্ত আলয় = বিদ্যালয় । ছাত্রদের জন্য আবাস = ছাত্রাবাস । দেবতার জন্য আলয় = দেবালয় প্রভতি ।
বি: দ্র: :- নিমিত্ত তৎপুরুষ সমাসে পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় এবং অনুসর্গ লোপ পায় ।
(ঘ) অপাদান তৎপুরুষ সমাস:- যে সমাসে অপাদান কারকের অনুসর্গ লোপ পায় সেই তৎপুরুষ সমাসকে অপাদান তৎপুরুষ সমাস বলে । যেমন— সত্য থেকে ভ্রষ্ট = সত্যাভ্রষ্ট । জন্ম হতে অন্ধ = জন্মান্ধ । পদ থেকে চ্যুত = পদচ্যুত । শাপ থেকে মুক্ত = শাপমুক্ত । এখানে 'থেকে', 'হতে', হল অনুসর্গ । এক্ষেত্রে অনুসর্গ লোপ পায়
(ঙ) অধিকরণ তৎপুরুষ :- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের অধিকরণ কারকের বিভক্তি, অনুসর্গ লোপ পায় তাকে অধিকরণ তৎপুরুষ বলে । যেমন— অকালে বোধন = অকালবোধন (এ) । অগ্রে গণ্য = অগ্রগণ্য (এ) । কারায় বদ্ধ = কারাবদ্ধ (য়) । লাটদের মধ্যে বড় = বড়লাট (মধ্যে) । এখানে 'এ', 'য়' 'মধ্যে' গুলি লোপ পেয়েছে এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পেয়েছে ।
(চ) সম্বন্ধ তৎপুরুষ :- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের সম্বন্ধ পদের বিভক্তি লোপ পায় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায় তাকে সম্বন্ধ তৎপুরুষ বলে । যেমন— রাজার পুত্র = রাজপুত্র (র) । পথের রাজা = রাজপথ (এর) । বিশ্বের মিত্র = বিশ্বামিত্র (এর) । এখানে 'র' 'এর' বিভক্তি লোপ পেয়েছে ।
(ছ) নঞ তৎপুরুষ সমাস:- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদ নঞর্থ অব্যয়, তাকে নঞ তৎপুরুষ সমাস বলে । যেমন— নয় শুভ = অশুভ । নয় সভ্য = অসভ্য । নয় ব্যক্ত = অব্যক্ত । নয় লাজ = নিলাজ । নয় দেশ = বিদেশ । নয় মিল = গরমিল ।
(জ) উপপদ তৎপুরুষ সমাস :- ধাতুর সঙ্গে কৃৎ প্রত্যয় যোগ করে কৃদন্ত পদ গঠিত হয় । আর এই কৃদন্ত পদের পূর্ববর্তী নামপদকে বলা হয় উপপদ । সুতরাং যে তৎপুরুষ সমাসে উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের সমাস হয় তাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে । যেমন— ইন্দ্রকে জয় করেছেন যে = ইন্দ্রজিৎ । গৃহে বাস করে যে = গৃহস্থ । অগ্রে জন্মেছে যে = অগ্রজ । সব জানে যে = সবজান্তা ইত্যাদি । এখানে 'জয়', 'বাস', 'অগ্রে', এবং 'সব' পদগুলি হল উপপদ ।
(ঝ) উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস :- বিভিন্ন উপসর্গ যোগে যে শব্দ সৃষ্টি হয় অর্থাৎ তৎপুরুষ সমাস হয় তাকে উপসর্গ তৎপুরুষ সমাস বলে । এ ক্ষেত্রে উপসর্গের অর্থই প্রাধান্য পায় । যেমন— দ্বীপের সদৃশ = উপদ্বীপ । নদীর সদৃশ = উপনদী । অক্ষির প্রতি = প্রতিপক্ষ । বে হিসাব = বেহিসাবী । ভাতের অভাব = হাভাত । কন্ঠের সমীপে = উপকণ্ঠ ইত্যাদি ।
(ঞ) ব্যাপ্তি তৎপুরুষ সমাস:- যে তৎপুরুষ সমাসে ব্যাপ্তির ভাব স্পষ্ট হয়, তাকে ব্যাপ্তি তৎপুরুষ সমাস বলে । যেমন— আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত = আগাগোড়া । চিরকাল ধরে শত্রু = চিরশত্রু । চিরকাল ধরে স্মরণীয় = চিরস্মরণীয় । চিরকাল ব্যাপী স্থায়ী = চিরস্থায়ী । আদি থেকে অন্ত = আদ্যন্ত ।
(২) কর্মধারয় সমাস :- যে সমাসে বিশেষ্য বা বিশেষণ জাতীয় পূর্বপদের সঙ্গে বিশেষ্য বা বিশেষণ জাতীয় পরপদের সমাস হয় এবং পরপদের অর্থ প্রাধান্য পায়, তাকে কর্মধারয় সমাস বলে । যেমন— নব যে অন্ন = নবান্ন । যিনি কর্তা তিনি মশায় = কর্তামশায় ।
♦ কর্মধারয় সমাসের শ্রেণীবিভাগ :- (ক) সাধারণ কর্মধারয় সমাস (খ) মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস (গ) উপমান কর্মধারয় (ঘ) উপমিত কর্মধারয় এবং (ঙ) রূপক কর্মধারয় সমাস ।
(ক) সাধারণ কর্মধারয় সমাস :- এই সমাসে কখনো বিশেষ্য + বিশেষ্য, বিশেষণ + বিশেষ্য, বিশেষণ + বিশেষণ পদের মধ্যে সমাস হয় । যেমন— যিনি দাদা তিনি বাবু = দাদাবাবু । যিনি গুরু তিনি মা = গুরুমা । যিনি ডাক্তার তিনি বাবু = ডাক্তারবাবু । এখানে বিশেষ্যের সঙ্গে বিশেষ্যর সমাস হয়েছে ।
বিশেষণ + বিশেষণ — যে মৃদু সেই মন্দ = মৃদুমন্দ । যে সাদা সে সিধা = সাধাসিধা । অম্ল অথচ মধুর = অম্লমধুর । কাঁচা অথচ মিঠা = কাঁচামিঠা ।
বিশেষণ + বিশেষ্য — নীল যে নদ = নীলনদ । ফুল যে বাবু = ফুলবাবু । বড় যে দাদা = বড়দাদা ।
(খ) মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস :- যে কর্মধারয় সমাসের মধ্যপদগুলি লোপ পায় সেই কর্মধারয় সমাসকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে । যেমন— সিংহ চিহ্নিত আসন = সিংহাসন । বিজয় সূচক উৎসব = বিজয়োৎসব । ভিক্ষা লব্ধ অন্ন = ভিক্ষান্ন । এখানে 'চিহ্নিত', 'সূচক', 'লব্ধ' পদগুলি মধ্যপদ । সমাসবদ্ধ পদে এগুলির অস্তিত্ব নেই ।
(গ) উপমান কর্মধারয় সমাস:- যে কর্মধারয় সমাসে পূর্বপদ উপমান এবং পরপদ সাধারণ ধর্মবাচক শব্দের সঙ্গে সমাস হয় তাকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে । যেমন— কাজলের মতো কালো = কাজলকালো । চিড়ের মতো চ্যাপ্টা = চিড়েচ্যাপট । কুসুমের মতো কোমল = কুসুমকোমল । হিমের ন্যায় শীতল = হিমশীতল । 'কালো ', 'চ্যাপ্টা', 'কোমল', ও 'শীতল' শব্দগুলি সাধারণ কর্মবাচক শব্দ ।
(ঘ) উপমিত কর্মধারয় সমাস :- যে তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদ উপমেয় বাচক এবং পরপদ উপমান বাচক হয় তাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে । এখানে উপমেয় পদের অর্থ প্রাধান্য পায় । যেমন— মুখ সোনার ন্যায় = সোনামুখ । বদন চাঁদের ন্যায় = চাঁদবদন । কথা অমৃতের ন্যায় = কথামৃত । মুখ হাঁড়ির ন্যায় = হাঁড়িমুখ । চরণ কমলের ন্যায় = চরণকমল । এখানে 'চরণ' উপমেয়, 'কমলের' উপমান, এবং 'ন্যায়' তুলনাবাচক শব্দ ।
(ঙ) রূপক কর্মধারয় সমাস :- যে কর্মধারয় সমাসে পূর্বপদ উপমেয় এবং পরপদ উপমানের মধ্যে অভেদ কল্পনা করা হয় তাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে । যেমন— ভব রূপ সাগর = ভবসাগর । মন রূপ পাখি = মনপাখি । কথা রূপ অমৃত = কথামৃত । জ্ঞান রূপ বৃক্ষ = জ্ঞানবৃক্ষ । ক্রোধ রূপ অনল = ক্রোধানল । এখানে ক্রোধ হল উপমেয় এবং অনল হল উপমান পদ ।
(৩) দ্বন্দ্ব সমাস :- যে সমাসে পূর্বপদ ও পরপদের অর্থ সমানভাবে গুরুত্ব পায়, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে । যেমন রাত ও দিন = রাতদিন । ভাই ও বোন = ভাইবোন ইত্যাদি ।
♦ দ্বন্দ্ব সমাসের শ্রেণীবিভাগ—
(ক) মিলনার্থক দ্বন্দ্ব — দুই ব্যক্তি বা বস্তুর মিলন বোঝাতে যে দ্বন্দ্ব সমাস হয় । যেমন— লক্ষ্মী ও নারায়ণ = লক্ষীনারায়ন । মাতা ও পিতা = মাতাপিতা । দুধ ও ভাত = দুধভাত । হর ও গৌরী = হরগৌরী ইত্যাদি
(খ) সমার্থক দ্বন্দ্ব :- যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলি সমার্থক বাচক শব্দ হয় । যেমন— জামা ও কাপড় = জামাকাপড় । কাগজ ও পত্তর = কাগজপত্তর । গাছ ও পালা = গাছপালা । টাকা ও পয়সা = টাকাপয়সা ইত্যাদি ।
(গ) বিপরীতার্থক দ্বন্দ্ব :- যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদগুলি বিপরীত ধর্মী শব্দ হয় । যেমন— লাল ও নীল = লালনীল । আলো ও অন্ধকার = আলোঅন্ধকার । দিন ও রাত = দিনরাত । ছেলে ও মেয়ে = ছেলেমেয়ে । ভাই ও বোন = ভাইবোন ইত্যাদি ।
(ঘ) সমাহার দ্বন্দ্ব :- দুই বা তার বেশি শব্দের সমষ্টি বা সমাহার বোঝায় । যেমন— মাছ ও মাংস = মাছমাংস । নদী ও নালা = নদীনালা । মুড়ি ও মুড়কি = মুড়িমুড়কি । আলু ও পোস্ত = আলুপোস্ত । রাজা ও রানি = রাজারানি প্রভৃতি ।
(ঙ) একশেষ দ্বন্দ্ব :- যে দ্বন্দ্ব সমাসে পূর্ব বা পরপদের প্রধান না হয়ে সম্পূর্ণ একটা নতুন পদ সৃষ্টি হয় তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব বলে । যেমন— সে ও আমি = আমরা । তুমি ও সে = তোমরা । তুমি, আমি ও আমরা = আমরা । আপনি ও তিনি = আপনারা । সে, আমি ও তুমি = আমরা ইত্যাদি ।
(৪) দ্বিগু সমাস :- দ্বি = দুই গো < গো শব্দের অর্থ গরু । দুটি গরুর সমাহার । দ্বিগু শব্দটি বিশ্লেষণ করলে এরূপ অর্থ পাওয়া যায় । যে সমাসে পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্য এবং ব্যাসবাক্যে সমাহার শব্দটি থাকে তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে । যেমন— অষ্ট ধাতুর সমাহার = অষ্টধাতু । শত অব্দের সমাহার = শতাব্দী । সপ্ত অহের (দিন) = সপ্তাহ । তিন মাথার সমাহার = তেমাথা । পঞ্চ নদের সমাহার = পঞ্চনদ । নব রত্নের সমাহার = নবরত্ন । সাত সমুদ্রের সমাহার = সাতসমুদ্র ইত্যাদি ।
(৫) বহুব্রীহি সমাস :- যে সমাসে সমস্যমান পদগুলির কোনোটির অর্থ প্রাধান্য না পেয়ে নতুন অর্থ প্রকাশ করে তাকে বহুব্রীহি সমাস বলে । যেমন— চন্দ্র চূড়ায় যার = চন্দ্রচূড় (শিব) । পদ্ম নাভিতে যার = পদ্মনাভ (বিষ্ণু) । বীনা পাণিতে যার = বীনাপাণি (সরস্বতী) ।
বি: দ্র: :- এই সমসের ব্যাসবাক্যে একটি যদ্ শব্দের অর্থ যিনি, যার বা যে থাকবে ।
♦ বহুব্রীহি সমাসের শ্রেণীবিভাগ:-
(ক) সমানাধিকরণ বহুব্রীহি :- যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্ব ও পরপদের বিভক্তি একই হয়, তাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি বলে । যেমন— পক্ব কেশ যার = পক্ককেশ । গৌর অঙ্গ যার = গৌরাঙ্গ । ছিন্ন মুল যার = ছিন্নমূল । নীল কন্ঠ যার = নীলকণ্ঠ । কু আকার যার = কদাকার ।
(খ) ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস :- যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্ব ও পরপদে ভিন্ন ভিন্ন বিভক্তি থাকে তাকে ব্যাধিকরণ বহুব্রীহি বলে । যেমন— শূল পাণিতে যার = শূলপাণি । চন্দ্র চূড়ায় যাঁর = চন্দ্রচুড় । রত্ন গর্ভে যার = রত্নগর্ভা ইত্যাদি ।
(গ) মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস :- যে বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্যের মধ্য পদগুলো লোপ পায় তাকে বলে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস । যেমন— কুম্ভের ন্যায় কর্ণ যার = কুম্ভকর্ণ । বৌ ভাত পরিবেশন করে যে অনুষ্ঠানে = বৌভাত । কমলের ন্যায় অক্ষি যার = কমলাক্ষ । চন্দ্রের মতো আনন্দ যার = চন্দ্রানন ইত্যাদি ।
(ঘ) ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস :- যে বহুব্রীহি সমাসে পরস্পরের মধ্যে একই প্রকার কাজ বোঝায়, তাকে ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস বলে । যেমন— চোখে চোখে যে দেখা = চোখাচোখি । গলায় গলায় যে মিল = গলাগলি । কানে কানে যে কথা = কানাকানি ইত্যাদি ।
(ঙ) সহার্থক বহুব্রীহি সমাস :- যে বহুব্রীহি সমাসে পূর্বপদের সহার্থক বাচক পরপদের সমাস হয় তাকেই সার্থক বহুব্রীহি সমাস বলে । যেমন— শব্দের সঙ্গে বর্তমান = সশব্দ । স্ত্রীর সঙ্গে বর্তমান = সস্ত্রীক । লজ্জার সঙ্গে বর্তমান = সলজ্জ । শিষ্যের সঙ্গে বর্তমান = সশিষ্য প্রভৃতি ।
(চ) নঞ বহুব্রীহি সমাস :- যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদ নঞর্থক অব্যয় হয় তাকে নঞ বহুব্রীহি সমাস বলে । যেমন— নাই অন্তর যার = অনন্ত । নাই খাদ যার = নিখাদ । নাই সঙ্গী যার = নিঃসঙ্গ । বে (নাই) পরোয়া যার = বেপরোয়া ইত্যাদি ।
(ছ) সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস :- যে বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ হয় সেটিকে সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি সমাস বলে । যেমন— দশ আনন যার = দশানন (রাবণ) । ত্রি নয়ন যার = ত্রিনয়ন (শিব) । পঞ্চ আনন যার = পঞ্চানন ইত্যাদি ।
(৬) অব্যয়ীভাব সমাস :- যে সমাসে পূর্বপদ অব্যয় ও পরপদ বিশেষ্য এবং সমস্ত পদে অব্যয়ের অর্থ প্রাধান্য পায় সেই সমাসকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে । যেমন— ভাতের অভাব = হাভাত । ফুলের সমীপে = উপকূল । কূলের বিপরীত = প্রতিকূল । দানের সদৃশ = অনুদান । দানের বিপরীত = প্রতিদান । ক্ষুদ্র বন = উপবন । গ্রহণের যোগ্য = অনুগ্রহ ইত্যাদি ।
(৭) নিত্য সমাস :- যে সমাসে ব্যাসবাক্য হয় না, ব্যাসবাক্যের জন্য অন্য কোনো পদের সাহায্য নিতে হয় তাকে নিত্য সমাস বলে । যেমন— অন্য দেশ = দেশান্তর । অন্য দ্বীপ = দ্বীপান্তর । অন্য যুগ = যুগান্তর । কেবল দর্শন = দর্শনমাত্র । অন্য মনু = মন্বন্তর । কেবল জ্ঞান = জ্ঞানমাত্র ইত্যাদি ।
(৮) অলোপ সমাস :- যে সমাসে পূর্বপদের বিভক্তি বা অনুসর্গ কিছুই লোপ পায় না তাকে অলোপ সমাস বলে । যেমন— তেলেভাজা = তেলেভাজা । মেঘে ঢাকা = মেঘেঢাকা । মামার বাড়ি = মামার বাড়ি । দুধে আলতা = দুধেআলতা ইত্যাদি ।
(৯) বাক্যাশ্রয়ী সমাস :- হাইফেন (-) চিহ্ন ব্যবহার করে কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ সমাসবদ্ধ একটি পদ রূপে প্রযুক্ত হয়, তখন তাকে বাক্যাশ্রয়ী সমাস বলে । যেমন— 'সবুজ বাঁচাও কমিটি', 'সব পেয়েছির দেশ', 'বসে আঁকো প্রতিযোগিতা', 'পণপ্রথা বিরোধী আন্দোলন', 'ভারতছাড়ো ডাক', 'ফেলে আসা দিনগুলি', ইত্যাদি ।
প্রশ্ন :-
বহু বিকল্প প্রশ্ন :-
(১) সমাসের বুৎপত্তি হল— (ক) সমা √আস + অ (খ) সমা √অস + অ (গ) সম্ √অস + অ (ঘ) সম্ + আস ।
(২) ব্যাসবাক্যের প্রথম পদকে বলে — (ক) সমস্যমান পদ (খ) ব্যাসবাক্য (গ) পূর্বপদ (ঘ) পরপদ ।
(৩) উভয় পদের অর্থ প্রাধান্য পায়— (ক) দ্বন্দ্ব সমাসে (খ) দ্বিগু সমাসে (গ) তৎপুরুষ সমাসে (ঘ) বহুব্রীহি সমাসে ।
(৪) সমাসবদ্ধ পদে নতুন অর্থ সৃষ্টি করে — (ক) তৎপুরুষ সমাসে (খ) বহুব্রীহি সমাসে (গ) কর্মধারয় সমাসে (ঘ) দ্বিগু সমাসে ।
(৫) 'বিস্ময়াপন্ন' সমাসের ব্যাসবাক্য — (ক) বিস্ময় দ্বারা আপন্ন (খ) বিস্ময়কে আপন্ন (গ) বিস্ময়ে আপন্ন (ঘ) বিস্ময়ের নিমিত্ত আপন্ন ।
(৬) 'দিনে দিনে' ব্যাসবাক্যটির সমাসবদ্ধ পদটি হল— (ক) প্রতিদিন (খ) রোজ দিন (গ) দিনদিন (ঘ) ফি দিন ।
(৭) 'গিরিশ' এর ব্যাসবাক্য হল— (ক) গিরির ঈশ (খ) গিরিকে ঈশ (গ) গিরিতে শয়ন করে যে (ঘ) গিরীর ঈশ ।
(৮) উপপদের সঙ্গে কৃদন্ত পদের যে সমাস হয় তাকে বলে — (ক) উপপদ তৎপুরুষ (খ) নিত্য সমাস (গ) বহুব্রীহি সমাস (ঘ) দ্বন্দ্ব সমাস ।
(৯) শাপ থেকে মুক্ত = শাপমুক্ত সমাসটি — (ক) করণ তৎপুরুষ (খ) নিমিত্ত তৎপুরুষ (গ) অপাদান তৎপুরুষ (ঘ) কর্ম তৎপুরুষ ।
(১০) উপমান কর্মধারয় সমাসের পূর্বপদটি হয়— (ক) বিশেষ্য (খ) বিশেষণ (গ) অব্যয় (ঘ) বিশেষণের বিশেষণ ।
(১১) যে সমাসে উপমেয় ও উপমানের অভেদ কল্পনা করা হয় তা হল—
(ক) উপমিত কর্মধারয় (খ) উপমেয় কর্মধারয় (গ) রূপক কর্মধারয় (ঘ) উপমান কর্মধারয় ।
অতি সংক্ষিপ্ত উত্তর ধর্মী প্রশ্ন:-
(১) সমাস শব্দের অর্থ কি ?
(২) সমস্যমান পদ কাকে বলে ? উদাহরণ দাও ।
(৩) সমাস ও সন্ধির মধ্যে মূলগত পার্থক্য কি ?
(৪) 'বহুব্রীহি' শব্দের অর্থ কী ?
(৫) 'দ্বন্দ্ব' শব্দটির অর্থ কী ? একশেষ দ্বন্দ্ব কাকে বলে ?
(৬) নিত্য সমাসের বৈশিষ্ট্য কি ?
(৭) সংখ্যাবাচক বহুব্রীহি কাকে বলে ?
(৮) উপমান ও উপমিত কর্মধারয় সমাসের মধ্যে পার্থক্য কি ?
(৯) নঞ বহুব্রীহি সমাস কাকে বলে ?
(১০) তৃতীয় বা অন্য পদের অর্থ প্রধান হয় কোন সমাসে ?
0 Comments
If you have any doubts, Please let me know.